নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কেবল মানুষ হত্যাই করেনি, ধ্বংস করেছে নানা অবকাঠামো। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করা সহজ ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে সেই অসাধ্যকে সাধন করেছিলেন। বাংলাদেশের খবরকে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ জমির। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোহসিন কবির। মোহাম্মদ জমির জানান, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি প্রথমে লন্ডন যান। সেসময় তিনিও সেখানে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু লন্ডন দেশে ফেরার পথে ভারতের দিল্লির পালাম এয়ারপোর্টে অবতরণের পর যে কথা বলেছিলেন, তা-ই ছিল বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের অন্যতম রূপরেখা। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘কারো প্রতি ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে নয়, বরং মানসিক উন্মত্ততার বদলে সৎবিবেচনা, কাপুরুষের স্থলে সাহস, অশুভর জায়গায় শুভ, বিচারহীনতার বিপরীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মিথ্যাকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত সত্যের যে জয় হয়েছে; চিত্তে সেই সন্তুষ্টি নিয়ে তিনি তাঁর স্বাধীন ভূমিতে ফিরছেন।’
মোহাম্মদ জমিরের মতে, বঙ্গবন্ধুর এই কথার প্রতিটি শব্দে একটা কনটেশন আছে। তিনি জেলখানায় থাকাকালীন যুদ্ধে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা সম্পর্কে তেমন জানতেন না। কিন্তু লন্ডন যাওয়ার পর তাকে যখন এসব বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। তিনি বলেন, বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থী যারা তখন দেশে ফিরছিলেন; তাদের পুনবার্সন, চিকিৎসা সহায়তা এবং দেশ পুনর্গঠনের বিষয়ে যেসব কথা বলেছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধুর দুরদর্শী চিন্তাধারার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমাদের অফিসিয়াল স্ট্রাকচারের মূলভিত্তি হতে হবে সততা। কারণ, দেশের জনগণের পয়সায় সবার বেতন হয়।’
রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় বাংলাদেশের হয়ে দায়িত্ব পালনকারী মোহাম্মদ জমিরের দৃষ্টিতে-বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছিলেন তা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। কারণ, বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি না পায় সেজন্য পাকিস্তান অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোকে বলতে থাকে যে ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, বাংলাদেশ ভারতের একটা অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। ভারতের অনেক সৈন্য সেখানে (বাংলাদেশে) রয়েছে।’
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন আমাদের নিয়ে বেইলি রোডের মাথায় তৎকালীন গণভবনে (যেটি বর্তমানে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট) একটি বৈঠক করেন। তিনি বললেন, ‘আপনাদের মনে রাখতে হবে, স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে হয়, তাহলে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে ভারতের সৈন্যরা যাতে তাদের দেশে ফিরে যায়।’
এরই অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় গিয়ে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সার্কিট হাউজে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব সালমান হায়দার ও দ্বিপি ধরসহ মোট তিনজন উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধিকে বললেন, ‘আপনারা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। আপনাদের সৈন্যরা যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আপনাদের প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন সময় এসেছে আপনাদের সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার।’
বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্ডিয়া ডেস্কের প্রধান (ডিরেক্টর ফরেন মিনিস্ট্রি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ জমির। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে শিক্ষা এবং যোগাযোগব্যবস্থার ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। পাশাপাশি শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ওপর জোর দেন। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রথমেই কমনওয়েলথের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এরপর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রচেষ্ঠা চালালে সেখানে চীন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বিশেষ করে ১ কোটি শরণার্থীদের পুনর্বাসনে জাতিসংঘের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বর্তমান আগাখানের দাদা সাদরুদ্দিন আগাখানকে এ বিষয়ে সহায়তার জন্য ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান তখন জাতিসংঘের পি-৫ কর্মকর্তা। তাদের সহায়তায় চীনকে ম্যানেজ করে পরবর্তীতে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন সরানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা কামনা করেন। যাতে চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করা যায়। কারণ, বিদেশ থেকে খাদ্য এবং জ্বালানি সহায়তা আনা না গেলে দেশ আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর এসব উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগ অবকাঠামো একটা মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়। যার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা ঝেড়ে অর্থনৈকিভাবে শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মন্তব্য করেন, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার এবং রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির।